Tuesday 31 January 2017

মুছে যাওয়া ডাকনাম...

অনেক বিয়ের ছবির মাঝে একা বসে আছে রক্তিমা। গগনেন্দ্রতে ওদের প্রদর্শনীর সময় প্রায় শেষ। তবু যেতে ইচ্ছা হচ্ছেনা। ওর চারপাশে সবাই হাসছে। কেউ ওর দিকে চেয়ে, কেউ একটু কায়দা করে পিছন ঘুরে , কেউ বা এখনো জ্বলতে থাকা বড় প্রদীপটার দিকে তাকিয়ে। মা বলত বিয়েতে হাসিটা নাকি বাধ্যতামূলক। ছবিগুলো দেখলেই তাই মায়ের কথা মনে পরে ওর। এখনো। শেষ সময়ের কিছু দর্শক এখনো রয়েছে। ওদের দেখা হলে রক্তিমাও বিদায় নেবে আজকের মত ছবিগুলোর কাছে। কালকের পর আর দেখা হবে না ছবিগুলোর সাথে। একেক দিকে ছড়িয়ে যাবে সবাই। দিদি , দাদা, কাকু ,কাকিমা শব্দ মিশে থাকা ছবিগুলো কালকে এই সাদা ঘর ছেড়ে নিজেদের ঠিকানায় চলে যাবে। যাদের যাদের ছবি তাদের কাছে। পরে থাকবে খালি এই সময়টা । সামান্য বেঁকে থাকা ছবিগুলোকে ঠিক করতে করতে এসবই ভাবছিল রক্তিমা। কখন যে ফাঁকা হয়ে গেছে চারপাশ, খেয়াল করেনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আর মিনিট পাঁচেক। কেউ নেই আর ।চলে যাওয়াই যায় এবার। কাঁধের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকাতে হল এবার। কাঁচের দরজাটা খুলে ঢুকে পড়েছে একটি ছেলে। চোখে মুখে অস্থিরতা। ' যদি কাল আসেন তাহলে খুব ভালো হয়। আজকের মত বন্ধ হয়ে যাবে এক্ষুনি।' ছবিগুলো দেখতে শুরু করেছিল সেই যুবক খুব দ্রুত। ঘুরে বলল ,' এখনো মিনিট তিন বাকি। কথা দিচ্ছি বেশি সময় নেব না।' গলার মধ্যে মিশে থাকা অনুরোধের সুরটাই বোধহয় কড়া হয়ে দিল না রক্তিমাকে। ঘড়ির দিকে  তাকিয়ে আর কিছু বলল না সে।
ছেলেটার যেন তাড়া আছে। এসব লোক যে কেন ছবি দেখতে আসে কে জানে? একটার পর একটা ভালো ছবি পেরিয়ে যাচ্ছে।সামান্য দাঁড়িয়ে  দেখছেও না । এসব লোক দেখলে খুব বিরক্তি আসে রক্তিমার। এখন রাগ হচ্ছে ।আদিত্য যে কেন নেই? ও থাকলে ঠিক কিছু একটা বলে বের করে দিত । এত লোকেদের স্বপ্ন আর জীবনের রঙ তুলে ধরেছে ওরা এখানে ,তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে পেরিয়ে যাওয়ার জন্য? যখন বিয়ের ছবি তোলাটাকেই প্রফেশন হিসেবে ভেবেছিল তখন সাহস ছিল না। আস্তে আস্তে বড় হয়েছে প্রচেষ্টা। অনেক ভালো লোক যোগ দিয়েছে। সংস্থা হিসেবেও নাম করেছে আজকাল। যতজনের বিয়েতে কাজ করেছে ওরা সবাই সেই কাজ নিয়ে খুশি । অথচ আজ সেই কাজগুলোই কত অবহেলা করে দেখছে মানুষ। এসব ভাবনার রেশ ছিড়ে বেরিয়েই ভাবল ছেলেটাকে বলে কাল আসবেন আবার। আবার থমকাতে হল।
একমনে একটা ছবি দেখছে সে দর্শক। দুচোখে বিস্ময় অনেকটা। তার মাথার পিছন দিয়ে তাকিয়ে দেখল ছবিটা। ওরই তোলা। অনন্যা আর গৌতমদার বিয়ের ছবি। অনেকখানি হাসিমুখ নিয়ে অনন্যা দাঁড়িয়ে সামনে। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে গৌতমদা আবছা হয়ে মিশে যাচ্ছে শহরের আলোয়। ' চলুন। আর আপনাকে আটকাব না। অনেক বিরক্ত করলাম।সরি। '  ছবিটার দিকে তাকিয়েই বলল ছেলেটা। তারপর ঘুরে এগিয়ে গেল বেরিয়ে যাওয়ার দরজার দিকে। 'একটু দাঁড়ান।' মন্তব্যের খাতাটা ওর দিকে এগিয়ে ধরল রক্তিমা। ম্লান হেসে তাতে কিসব লিখল ছেলেটা। খাতা ফেরত নিয়ে রক্তিমা দেখল ভাল মন্তব্যে যোগ হয়েছে নতুন। শুধু নাম নেই। অবাক চোখে তাকাতেই পড়তে পারল বোধহয় প্রশ্নটা শেষ দর্শক। উত্তর দিল না। প্রশ্ন করলো নতুন, ' অনন্যার সাথে যোগাযোগ আছে আপনার? কেমন আছে জানেন ওরা? ' শেষের দিকে গলার স্বর হালকা। বেশ কষ্ট করে প্রশ্নটা করতে হচ্ছে বুঝছে পারা যাচ্ছে। পেশাদারী গাম্ভীর্যে চুপ করে ছিল রক্তিমা।ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কি? দরজার দিকে ঘুরে গেছে দর্শক। এবার বেরিয়ে মিলিয়ে যাবে ভিড়ে। ' ওরা এখন নেই এখানে। দেশের বাইরে যতদূর সম্ভব। শেষ বার কথা হওয়ার সময় বলেছিল অনন্যা।' উত্তরটা বেরিয়ে গেল। বোধহয় আজকের শেষরাতের এই গল্প অসমাপ্ত রাখতে চাইল না কেউ। ফিরে সামান্য হাসল ছেলেটি। কৃতজ্ঞতার। চলে যেতে যেতে বলল , ' গোটা শহরটায়  কতশত ডাকনাম মুছে যাচ্ছে প্রতিদিন। তাই মন্তব্যটায় আমার নাম দিলাম না। আপনাকে খুব জ্বালালাম আজ। চলি।'
ভিড় গিলে নিল চেহারাটা । অনন্যার ছবি এখনো হাসছে। শুধু রক্তিমা বুঝতে পারছে না অত আলোয় মুড়ে ছবিটাকে তুলে ও কি এই মুখটাকে অন্ধকার করে দিচ্ছিল ?  ওর রিং টোন বাজছে-
            ''আরও একটু দূরে দূরে ,কোন পথ হারা সুরে,তুমি এক ভবঘুরে,                                                             ঘুরবেই।
            কোন ক্লান্ত দুপুরে,এই ব্যস্ত সহরে,জানি ঘুম ভেঙ্গে ঘরে ফিরবেই।''
   এই এত আলো, হাসিমুখ -এত কিছু পেরিয়ে কি ঘরে পৌছতে পারে সবাই???