Sunday 30 May 2021

অল্প অল্প ঝাপসা গল্প

আজকাল লিখতে ইচ্ছে করে আর তারপরেই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে সেই লেখা। কিছুতেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়না লেখায়। অথচ নিজেকে খুঁজতে চেয়েই সব লেখা। সব লেখায় নিজের অনেকটা করে দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে কিন্তু হয়ে ওঠেনা কিছুতেই। একটা ঝিম ধরা শহরে আরো ঝিম ধরা আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল। দিক গুলিয়ে যায়, মানুষ গুলিয়ে যায়, মাঝে মধ্যে গুলিয়ে ফেলি নিজেকেও। 
চিঠির সাথে একসময় খুব সখ্য ছিল অথচ চিঠিরাও ঝাপসা হয়ে আসে। শব্দগুলো যেগুলো খুব সত্যি মনে হত ততটা সত্যি লাগে না এখন। মনে হয় নিজেকেই প্রতারণা করতে পারে শব্দগুলো। অথচ একসময় হৃদয়ের গভীর কথাগুলোই মিশে যেত অনায়াসে। না থেমে একটানা শব্দগুলো আসতো। আমি কি তখন অসৎ ছিলাম? না এখন অসৎ?ঠিক বুঝতে পারি না।
মেঘলা করে এলেই একটা খুব অদ্ভুত ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কোন একটা পরিত্যক্ত রানওয়ে তে বসার কথা ছিল আমার ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে। তার ঠিক পাশেই একটা স্বচ্ছ জলাশয়। এরকম অদ্ভুত কথা কে কবে শুনেছে? তবু আমি স্পষ্ট দেখতে পাই জায়গাটা। মেঘের আড়াল থেকে অল্প একটু রোদ চিনিয়ে দেয় বৃষ্টিদের আর আমি বসে থাকি ঠিক মাঝখানে । যেখান থেকে টেক অফ করার কথা ছিল প্লেনটার। 
আমার প্রথম ব্লগের নাম ছিল পাগলামির সীমানা আর সময়ের হাতছানি। সময় জিনিসটা অদ্ভুতভাবে খুব ছোটবেলা থেকেই ভাবায় আমায়। একদিন না একদিন নিশ্চয়ই আমি সময় সম্পর্কে সব জেনে ফেলতে পারবো। সেদিন কি খুব পুরোনো কিছু বদলে ফেলতে চাইবো প্রয়োজনে। সবকিছু অন্যরকম করে দিতে চাইবো? জানি না ঠিক আমি। অনেক কিছু না জানার তালিকায় এটাও পড়ে আছে।
আমরা সবাই আমার মনে হয় সীমান্তবর্তী পাগল।আর একটু এগিয়ে বর্ডার ক্রস করলেই আমাদেরকে পুরো পাগল আখ্যা দিতে পারবে পৃথিবী। আমরা পারি না অথচ চাই বর্ডার টুকু পার করতে। কোন না কোন সময়। আমি অন্তত চাই। না পারাটুকুই যন্ত্রণা নিয়ে আসে। একটা সীমাহীন শূন্যতা। আচ্ছা শূন্যতার গায়ে রোদ পড়লে কি রামধনু জন্মায়?

Tuesday 31 January 2017

মুছে যাওয়া ডাকনাম...

অনেক বিয়ের ছবির মাঝে একা বসে আছে রক্তিমা। গগনেন্দ্রতে ওদের প্রদর্শনীর সময় প্রায় শেষ। তবু যেতে ইচ্ছা হচ্ছেনা। ওর চারপাশে সবাই হাসছে। কেউ ওর দিকে চেয়ে, কেউ একটু কায়দা করে পিছন ঘুরে , কেউ বা এখনো জ্বলতে থাকা বড় প্রদীপটার দিকে তাকিয়ে। মা বলত বিয়েতে হাসিটা নাকি বাধ্যতামূলক। ছবিগুলো দেখলেই তাই মায়ের কথা মনে পরে ওর। এখনো। শেষ সময়ের কিছু দর্শক এখনো রয়েছে। ওদের দেখা হলে রক্তিমাও বিদায় নেবে আজকের মত ছবিগুলোর কাছে। কালকের পর আর দেখা হবে না ছবিগুলোর সাথে। একেক দিকে ছড়িয়ে যাবে সবাই। দিদি , দাদা, কাকু ,কাকিমা শব্দ মিশে থাকা ছবিগুলো কালকে এই সাদা ঘর ছেড়ে নিজেদের ঠিকানায় চলে যাবে। যাদের যাদের ছবি তাদের কাছে। পরে থাকবে খালি এই সময়টা । সামান্য বেঁকে থাকা ছবিগুলোকে ঠিক করতে করতে এসবই ভাবছিল রক্তিমা। কখন যে ফাঁকা হয়ে গেছে চারপাশ, খেয়াল করেনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আর মিনিট পাঁচেক। কেউ নেই আর ।চলে যাওয়াই যায় এবার। কাঁধের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকাতে হল এবার। কাঁচের দরজাটা খুলে ঢুকে পড়েছে একটি ছেলে। চোখে মুখে অস্থিরতা। ' যদি কাল আসেন তাহলে খুব ভালো হয়। আজকের মত বন্ধ হয়ে যাবে এক্ষুনি।' ছবিগুলো দেখতে শুরু করেছিল সেই যুবক খুব দ্রুত। ঘুরে বলল ,' এখনো মিনিট তিন বাকি। কথা দিচ্ছি বেশি সময় নেব না।' গলার মধ্যে মিশে থাকা অনুরোধের সুরটাই বোধহয় কড়া হয়ে দিল না রক্তিমাকে। ঘড়ির দিকে  তাকিয়ে আর কিছু বলল না সে।
ছেলেটার যেন তাড়া আছে। এসব লোক যে কেন ছবি দেখতে আসে কে জানে? একটার পর একটা ভালো ছবি পেরিয়ে যাচ্ছে।সামান্য দাঁড়িয়ে  দেখছেও না । এসব লোক দেখলে খুব বিরক্তি আসে রক্তিমার। এখন রাগ হচ্ছে ।আদিত্য যে কেন নেই? ও থাকলে ঠিক কিছু একটা বলে বের করে দিত । এত লোকেদের স্বপ্ন আর জীবনের রঙ তুলে ধরেছে ওরা এখানে ,তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে পেরিয়ে যাওয়ার জন্য? যখন বিয়ের ছবি তোলাটাকেই প্রফেশন হিসেবে ভেবেছিল তখন সাহস ছিল না। আস্তে আস্তে বড় হয়েছে প্রচেষ্টা। অনেক ভালো লোক যোগ দিয়েছে। সংস্থা হিসেবেও নাম করেছে আজকাল। যতজনের বিয়েতে কাজ করেছে ওরা সবাই সেই কাজ নিয়ে খুশি । অথচ আজ সেই কাজগুলোই কত অবহেলা করে দেখছে মানুষ। এসব ভাবনার রেশ ছিড়ে বেরিয়েই ভাবল ছেলেটাকে বলে কাল আসবেন আবার। আবার থমকাতে হল।
একমনে একটা ছবি দেখছে সে দর্শক। দুচোখে বিস্ময় অনেকটা। তার মাথার পিছন দিয়ে তাকিয়ে দেখল ছবিটা। ওরই তোলা। অনন্যা আর গৌতমদার বিয়ের ছবি। অনেকখানি হাসিমুখ নিয়ে অনন্যা দাঁড়িয়ে সামনে। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে গৌতমদা আবছা হয়ে মিশে যাচ্ছে শহরের আলোয়। ' চলুন। আর আপনাকে আটকাব না। অনেক বিরক্ত করলাম।সরি। '  ছবিটার দিকে তাকিয়েই বলল ছেলেটা। তারপর ঘুরে এগিয়ে গেল বেরিয়ে যাওয়ার দরজার দিকে। 'একটু দাঁড়ান।' মন্তব্যের খাতাটা ওর দিকে এগিয়ে ধরল রক্তিমা। ম্লান হেসে তাতে কিসব লিখল ছেলেটা। খাতা ফেরত নিয়ে রক্তিমা দেখল ভাল মন্তব্যে যোগ হয়েছে নতুন। শুধু নাম নেই। অবাক চোখে তাকাতেই পড়তে পারল বোধহয় প্রশ্নটা শেষ দর্শক। উত্তর দিল না। প্রশ্ন করলো নতুন, ' অনন্যার সাথে যোগাযোগ আছে আপনার? কেমন আছে জানেন ওরা? ' শেষের দিকে গলার স্বর হালকা। বেশ কষ্ট করে প্রশ্নটা করতে হচ্ছে বুঝছে পারা যাচ্ছে। পেশাদারী গাম্ভীর্যে চুপ করে ছিল রক্তিমা।ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কি? দরজার দিকে ঘুরে গেছে দর্শক। এবার বেরিয়ে মিলিয়ে যাবে ভিড়ে। ' ওরা এখন নেই এখানে। দেশের বাইরে যতদূর সম্ভব। শেষ বার কথা হওয়ার সময় বলেছিল অনন্যা।' উত্তরটা বেরিয়ে গেল। বোধহয় আজকের শেষরাতের এই গল্প অসমাপ্ত রাখতে চাইল না কেউ। ফিরে সামান্য হাসল ছেলেটি। কৃতজ্ঞতার। চলে যেতে যেতে বলল , ' গোটা শহরটায়  কতশত ডাকনাম মুছে যাচ্ছে প্রতিদিন। তাই মন্তব্যটায় আমার নাম দিলাম না। আপনাকে খুব জ্বালালাম আজ। চলি।'
ভিড় গিলে নিল চেহারাটা । অনন্যার ছবি এখনো হাসছে। শুধু রক্তিমা বুঝতে পারছে না অত আলোয় মুড়ে ছবিটাকে তুলে ও কি এই মুখটাকে অন্ধকার করে দিচ্ছিল ?  ওর রিং টোন বাজছে-
            ''আরও একটু দূরে দূরে ,কোন পথ হারা সুরে,তুমি এক ভবঘুরে,                                                             ঘুরবেই।
            কোন ক্লান্ত দুপুরে,এই ব্যস্ত সহরে,জানি ঘুম ভেঙ্গে ঘরে ফিরবেই।''
   এই এত আলো, হাসিমুখ -এত কিছু পেরিয়ে কি ঘরে পৌছতে পারে সবাই???

Wednesday 25 May 2016

প্রাক্তন

প্রাক্তন কথার অর্থ পুরনো। পূর্বতন বলে পাশ কাটানো যেত অবিশ্যি কিন্তু সেই ছাপটুকু গায়ে না রেখেই ব্যাপারটা একেবারে পুরনো। ঠিক যেন ইট কাঠের ঝুরঝুরে কিছু বালির গুঁড়ো মিশে একেবারে প্রাচীন। অথচ পুরোপুরি প্রাচীনের গণ্ডিতে ঢুকে যে একেবারে স্মৃতির ক্যানভাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে ,তাও নয়। রঙ আছে , তবে সে রঙ না থাকারই সামিল। রঙ ছিল কোন কালে। বেশ উজ্জ্বল একটা রঙ। মন কেড়ে নেওয়ার মতই। মন কাড়তে কাড়তে সেটা এসে দাঁড়িয়েছে ধূসরে। হয়তো রাঙ্গানো যেত। হয়তো তুলির দু চারটে আঁচড়েই ফিরে পেত প্রাণ। তুলি টুকু জোটে নি কপালে। ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এক্কেবারে দূরে। সকলের চেয়ে আড়ালে। যেখানে ওর দাম কানাকড়িও নয়। এইখানে এসে একটু হোঁচট খেতে হয়। কানাকড়িও নয় ? তাহলে কি বলে ও রয়ে গেল চোখের আড়ালে। থেকে গেল একটু জায়গা নিয়ে? থাকার কথা তো নয়? টেনে হিঁচড়ে বার করে ফেলে দেওয়ার কথা ছিল যেখানে। সেখানে দিব্যি আসর জমিয়ে বসে আছে । অন্ধকারে মনের মাঝে বিদ্যুতচমকের মতো দেখা দেয়। কথা বলে যায় এমনভাবে যেন কিছুই হয়নি এখনো। তুলির দাগের রঙগুলো আবার ফিরে আসে কি? ফিরে আসার কথা ছিল। বলে গিয়েছিল যেন ফিরে আসবে। না বলে চলে যাওয়ার কথা ছিলনা হয়তো। বলে যেতে পারেনি বলে ক্ষমাটুকুও রয়ে গেছে অধরা। 'তবু মনে রেখো' গানটাও কেউ গেয়ে দেয়নি ঠিক সময়ে। তাই ভুলে গেছে দুজনে দুজনকে। হারিয়ে ফেলেছে রাস্তার ধারের গল্পগুলোর মতই। বৃষ্টি ভেজা বাসের জানলার আবছা কাঁচের ওদের প্রতিবিম্ব গুলোও বদলে গেছে হয়ত তাই।অন্যদের মুখ ওদের ছবিতে বসে খুব জ্বালায় ওদের। কি চেয়েছিল আর কি পেয়েছে এই ভাবনাটুকুও আর আসেনা তাই। অভিমানী মুখ দুটো ফোনের ছবিগুলোতে খুঁজতে চায় নিজেদের চেনা মানুষটাকে। এখন যে আর একই নেই। তাকে। সকলে নিজেদের একলা ভাবে বড্ড। সাহস পেয়ে যায়। সেই সাহসেই অন্যের চোখটুকু হারিয়ে যায় হয়তো। অন্যই হয়ে যায় চাহনি। সেই চাহনিকে চেনা বড় দায়। সেই অন্য মানুষটাকে চেনাও। তাই 'হে বন্ধু বিদায়' বলে যে পথ বেঁকেছিল দুজনার, সেই পথ একই থাকে। শুধু দুজনে ভাবতে থাকে যে পথ বেঁকে গেছে বড্ড।  আর দুজনে দুজনকে দেখে বড্ড অচেনা সাজে। যেরকম অচেনা সাজলে হেটে চলে যাওয়া যায় নতুন দুজনের পাশ দিয়ে। ঠিক সেরকম। কোথাও বড্ড ফাঁকা লাগে তবু। বিসর্জনের মতই... প্রাক্তন হতে হতে...

Thursday 25 February 2016

ইচ্ছে হয় তাই...

                                    

বেঁকে থাকা চেয়ারটার মাথার উপরে ঘড়িটা এগিয়ে চলেছে নিজের মতন।ও থামতে জানে না, অন্তত অনেকদিন থামেনি। কাল রাতে মারা গিয়েছিল যারা ,সেসব সিগারেটের মৃতদেহ ছাইয়ের থেকে মুখ বাড়িয়ে আছে ।ওরা মরতে  চেয়েছিল কিনা সেসব কেউ জানতে চায়নি। জানতে চায় না। ওদের খুনিরা এখন ঘুমোচ্ছে। কেউ খাটে , কেউ বা মেঝেতে। সকলের মুখেই ছেলেমানুষি লেগে আছে। ওরা স্বপ্ন দেখছে। নতুন বা পুরনো স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পরে ওদের এই ঘুমনোটাও স্মৃতি হয়ে যাবে। তখনও এভাবেই ঘুমের মধ্যে হাসাতে আসবে কি এই মুহূর্তটাও ?
                                                    ১
সমুদ্র ওদের ডেকেছিল । সপ্তাহখানেক আগে। বিরাট গর্জনের সাথে ঠাণ্ডা হাওয়া মিশিয়ে জানিয়েছিল স্বাগত। কটেজের নরম আলোয় মেশা রাত আর পুকুরপাড়ের BONFIRE- এ গাওয়া গান জানিয়ে দিচ্ছিল ওদের যে জীবনটা এতোটা কঠিনও নয়। যতটা ওরা ভাবে। হ্যাঁ। চেষ্টা করে ওরাও নিজেদের মত সবকিছু সহজ করে নিতে। কিন্তু নিজেদের শহর ছেড়ে দূরে এসে সেই চেষ্টাটুকুও করতে হচ্ছে না আর। 'কাকতাড়ুয়া'ই হোক অথবা 'গুলাবি আঁখে' সবেতেই ওরা খুঁজে নিচ্ছে আনন্দের পথ। রাতজাগা গল্পগুলোতে পড়ে থাকছে অনেক পুরনো- নতুন কথা, আনন্দ হাসিঠাট্টা । জানাতে হচ্ছে না কষ্ট করে আমরা বেঁচে আছি।  এলোমেলো ঝাঁপে আর সমুদ্রের সাথে লড়াইতে পরের দিন বোঝা যাচ্ছিল জলটা নোনতা, ওরা নয়। তাই দু আঙ্গুল জলে ঝাপিয়ে কেউ উঠছিল জলদৈত্য সেজে খাবি খেতে খেতে , আবার কেউ একটু বেশি জলে ঝাপিয়ে দেখছিল কিভাবে ঢেউয়েরা মাথার উপর দিয়ে পালায়। একজন এসব কিছু থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, না না খুঁজছিল কিছু। কাউকে বুঝতে না দিয়ে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখছিল বাকিদের। মনে পড়ছিল আরও একজোড়া পায়ের কথা। যে জোড়া হেঁটেছিল ওর সাথে সমুদ্রের পাড়ে অনেকক্ষণ । হাত ধরে বুঝিয়েছিল এই যে জলগুলো ফিরে যাচ্ছে আবার সমুদ্রে , এরা মুছে দিতে পারবেনা ওদের পায়ের ছাপ। খুব ইচ্ছা করছিল বালি খুড়ে দেখতে ।এখনো কোথাও কি থেকে যেতে পারেনা ছাপগুলো ? এই জলগুলো হয়তো জানে ।জলের দিকে এগোতে এগোতে দেখল সবাই ডাকছে। এবার ছবি তোলার পালা একসাথে। শুনেছিল সমুদ্র কিছু নেয় না, ফিরিয়ে দেয়। ঐ দুটো পায়ের ছাপ নিয়ে এতগুলো পায়ের ছাপ ওর জন্য নিয়ে এসেছে তাই ? কিন্তু আরও একটু উদার হতে কি পারতো না সমুদ্র ? হারিয়ে যাওয়া হাসিটা আবার ফেরত এল মুখে । নাকি মুখোশটা হেসে উঠলো আবার ? জানা গেল  না এতটুকু...

                                                        ২
নোনাজলগুলো শুকিয়ে গিয়েছে বেশ কিছুদিন।ছবিগুলো স্মৃতি হয়ে যেতে বসেছে। হালকা হয়ে আসছে পাগলামিরা , আর জীবন গলার দড়িটা টেনে ধরেছে খুব জোরে। দাগ বসে যাচ্ছে অকারণ। আকাশটা দুদিনের জন্য বড় হয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে হঠাৎ কমে গেলে পরিধিটা ভালো লাগে না মোটেও। এই সত্যিটা বুঝতে বুঝতে ওরা ঠিক করল স্মৃতিগুলোকে হালকা হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। কারণ হালকা হলেই মিলিয়ে যায় সব তাড়াতাড়ি। কর্পূরের মতই উবে যায় বলা চলে। তাই ঠিক হল আকাশ না বানাতে পারলেও ওরা ভেবে নেবে আকাশ আছে। বেশ দিব্যি বড় একটা আকাশ । হালকা আলোয় মোড়া এই মিথ্যে কথার শহরে যেটার খুব প্রয়োজন। আর প্রয়োজন জীবন থেকে যেটা হারিয়ে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি সেই আনন্দ নামক বস্তুটিকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনা। শুরুটা খুব দ্রুতগামী। দুজন ছেলে ভোরের আলো গায়ে মেখে বেরিয়ে পড়ল বাইকে। আশেপাশের অনেক ছোটবড়  দাবীকে অনায়াসে পাশ কাটিয়ে একটা ছোট শহর থেকে বাইকটা ঢুকে পড়ল একটা বড় শহরে। তিলোত্তমায়। বাইকওয়ালার ফ্ল্যাট  আগেও দেখেছে ওদের। আজকে দেখেও বুঝতে পারল নরক গুলজার হতে চলেছে। জানা গেল পাপের ভাগীদাররা কেউ পৌছবে না অত সকালে। কেউ রক্ত দিচ্ছে, কারো মন চুড়িদার আর ব্যাগে , কেউ শেখাচ্ছে কিভাবে পেটানোটাও শিল্প হয়ে উঠতে পারে আর কেউ এত দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে  অফিসের 
যে সব তালার চাবি তার হাতে হয়ে জীবনটা গলায় চলে এসেছে। সব শূনে হতভম্ব হয়ে দুজনের গান পেল। ফাঁকা ফ্ল্যাট শুনল ওদের শেয়ালের কান্না । সেই কান্নাতেও যখন মাথায় হাত বোলাবার পাওয়া গেল  না কাউকে তখন তারা ঠিক করল দেহ রাখবে। সাতসকালে রাখা সেই দেহরা আবার জেগে উঠলো প্রায় সন্ধ্যাতে। যখন শোনা গেল একজন সারাদিনের ড্রাকুলাবৃত্তির পর মুক্তি পেয়ে রক্ত বন্ধ করে আসতে চলেছে। প্রায় হতাশ হয়ে দুজনে তখন চিকেন রোল চিবচ্ছিল কোথাও একটা বসে। চাপ না নিয়ে চিকেন রোলের দাবি মিটিয়ে ওরা ফিরে এল গন্তব্যে। এবারের গল্পটা আলাদাই। সবাই এসে গেল তাদের আসার আনন্দে খোলা হল রঙিন জল। দুরকমেরই। সেই রঙিন জলের জন্য চারপাশে যে বিপ্লব হচ্ছিল সেই বিপ্লবের সাক্ষি ছিল একটি ছেলে যে কোনায় বসে চুপচাপ অপেক্ষাকৃত নরম রঙিন জল ঢালছিল গলায় আর বুঝতে পারছিল উদ্দেশ্যহীনতা। যখন ভারী রঙিন জল বেসামাল করে ফেলছে এক এক জনকে , খুঁজে নিচ্ছে তাদের মধ্যের অসহায় মানুষটাকে ; বোঝা যাচ্ছে কেউ ভালো নেই। এই অসহায়তাটাই হয়তো সহজ করে তুলছে পরিবেশ। হঠাৎ ভেঙ্গে পড়া কান্নাতেই হোক অথবা অযাচিত খিল্লিতে- সবাই হালকা হতে চাইছে। ভেসে বেড়াতে চাইছে নিজেদের সমস্যাগুলোর থেকে দূরে। অনেকখানি দূরে। সুখ খুজছে না ওরা। শুধু মুহূর্তগুলো ওদের শান্তি দিচ্ছে অকারণ। এরই মাঝে বিরিয়ানি এবং রঙিন জল সহ্য করতে না পেরে বাথরুম খুঁজে চলেছে এক হতভাগা। বার ছয়েক নিজের অন্নপ্রাশনের ভাত উঠিয়ে এসে প্রায় ভিজে অবস্থায় সে মাটিতে শুয়ে। এদিক ওদিক হাত বাড়াচ্ছে। কি চাই সেটা নিজেও জানে না।জানা সম্ভবও নয় যদিও। মুখে হাসিটুকু লেগে আছে ঠিক। বোঝাচ্ছে ও ঠিক আছে। ওর ঠিক পাশে বসে খাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত সবাই খালি বুঝতে পারছে না কোনটা রুটি আর কোনটা চিকেন ভর্তা। একটা ছেঁড়া রুটিকে ছেড়ার প্রবল চেষ্টায় ব্যাস্ত একজন অন্যকে দেখিয়ে বলছে দেখ ও কিরকম ছড়াচ্ছে। ছড়াচ্ছে সবাই। শুধু আশা করা যাচ্ছে যে এই ছড়ানোগুলোকে জীবন গুছিয়ে রাখবে। স্মৃতির পাতায়।

                                                      ৩
গভীর রাতের হ্যাংওভার কখন কাটে জানা নেই। সাদা জল খেলে সেটা বোঝা যায় না। তবে চারপাশের মাথা ধরে অথবা ত্রিভঙ্গ অবস্থায় শুয়ে  থাকা মানুষগুলোকে দেখলে বোঝা যাচ্ছে যে খোঁয়ারি কাটেনি এখনো। শুধু বিরিয়ানির বিষ দেহ থেকে বার করা ছেলেটি সুস্থ হয়ে জানতে চাইছে কেউ কফি খাবে কিনা। কেউ সম্মতি দিচ্ছেনা বটে তবে বোঝা যাচ্ছে আপত্তিও নেই কারোরই। অবশেষে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কফি বানিয়েই আনল ছোকরা। cafe cofee day আশা করেনি কেউই তাই কাপে কফি নিয়েই ক্ষান্ত হল সবাই। কিন্তু তারপর যখন ছেলেটি প্রশ্ন করতে আরম্ভ করল ' কিরে? কেমন হয়েছে কফি? ' , পাগল করে দিতে লাগলো উত্তর না পেয়ে তখন সব্বাই একবাক্যে স্বীকার করল যে ক্যাফে কফি ডে তে ওর চাকরি বাঁধা।
এবং ততক্ষন বলতে লাগলো যতক্ষণ না ছেলেটি প্রশ্ন বন্ধ করছে।এবার প্রশ্ন এল বাড়ি ফেরার। রোববার হয়নি শেষ তখনও। তাই বাড়ি ফেরার বদলে ভাবা হল নতুন পাগলামোর কথা। আজও যদি থেকে যাওয়া হয় একইভাবে ? একই ভাবে নষ্ট করা যায় দিনটা ? প্রশ্নটা বড় হলেও উত্তরে আসতে দেরি হল না। কেউ বাঁধা পথে চলতে রাজি নয়। অতএব এখানেই রাত্রির আশ্রয়।
প্রশ্ন ছিল রঙিন জলেও। কিন্তু রঙ প্রশ্ন মেখে থাকে না বেশিক্ষণ। তাই প্রশ্ন ভেঙ্গে বেরিয়ে এল রঙিন জল। আগের দিনের মতো এলাহি আয়োজন নয়। চুমুকটুকুই থাকবে সাথে। চুমুকগুলোর গিয়ে থামল আলোচনায়। গান বাজনা আর দেদার ভুল বকার পর জীবনের পুরনো দরজাগুলোয় কড়া নাড়াবার পালা এবার। ঝুরঝুরে আর প্রায় ভেঙ্গে পড়া দরজাগুলোকে সামলাচ্ছিল পুরনো আমি অথবা আমরা। ঐ দরজা আর খুব পুরনো নিজেদের মাঝে মধ্যে সকলে খোঁজে,miss   করে। একলা সময়ে ,নির্জনতায়। আজ নির্জনতা নেই। তবু আজ খুঁজে পেতে অসুবিধা হচ্ছে না তাদের। নির্দ্বিধায় আসছে তারা। সিগারেটের ধোঁয়ারা ঘুরছে ঘরের মধ্যে। আগুন টেনে ধোঁয়া বের করে শান্তি পেতে চাইছে সবাই। শুধু বুঝতে পারছে না ভিতরে কোথাও আগুন লেগেছে খুব বড় করে, যার ধোঁয়া বেরোনোর পথ নেই। কারো গায়ে লেগে থাকা সিগারেটের আগুনের ছাপে, কারো চুরি যাওয়া টাকায়, আর কারো করে যাওয়া বিশ্বাসঘাতকতায় গোটা রাত বাড়ছে। প্রতিদিনই বাড়ে। অনেকগুলো ছাই পড়ে থাকে যেগুলোর নাম ভালবাসা। ভালবাসতে বাসতে আমরা বড় হই। পুরনো আমি কে কোথাও একটা হারিয়ে ফেলি আর খুঁজি ।আর খুঁজতে খুঁজতে বুঝে যাই জিনিসটা যেটাকে ভাবা হয়েছিল গোটা জীবন সেটা কখন যেন ধাক্কা মেরে ,দুমড়ে , পায়ের তলায় মাড়িয়ে চলে গেছে আমাকে। আমি পড়ে আছি, পড়ে থাকব ,বয়ে নিয়ে যাবো ক্ষতচিহ্নগুলো আর ভাঙব প্রতিরাতে। বোঝাবো নিজেকে ভালো আছি। চেষ্টাও করবো ঠিক। শুধু রাতটুকু আর অন্ধকার বেড়ে যাবে। সেসবের পরে এলোমেলো পাগলামিতে, মাতলামিতে ভালো  থাকতে চেষ্টা করবো বারবার। যতদিন না শেষটুকু দেখতে পাচ্ছি।

পুনশ্চ ঃ
রাতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মেই শেষ হয়। পাখি ডাকে সকালে। ঘুম ভেঙ্গে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়ি আবার। তবু কোথাও না কোথাও রাতগুলো থেকে যায়। একসাথে থেকে একে অপরকে বোঝাটুকু থেকে যায়। একে অপরকে হাসানোর চেষ্টাগুলো থেকে যায়। আমরা থেকে যাই। আর কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকে আমাদের ভিতরকার পুরনো মানুষগুলো। যারা হাসতে জানত প্রাণ খুলে। ভালবাসতে জানত চোখ বন্ধ করে। সেসব হারানো লোকগুলো ফিরে ফিরে আসবে বারবার। যতদিন আমরা একসাথে থাকব সবাই। ততদিনই পৃথিবীটা বড় সুন্দর হয়ে থাকবে... 

Wednesday 23 September 2015

শহর ও দুজন 

আবির-

ইনবক্স ভরে গেছে মেসেজে। এখনো seen হয়নি একটাও। তবু লিখেই চলেছে আবির। একটা অদ্ভুত পাগলামি কাজ করছে ওর ভিতরে। তাই থামতে চেয়েও পারছে না থামতে। ও জানে অপালা এগুলো দেখবে না। দেখছে না ।বলা ভালো দেখতে চাইছে না। 
তবু থামা যাচ্ছে না।
অনেকগুলো কথা বলার আছে। অনেকগুলো কথা বলে ফেলা দরকার। যেগুলো পরে বললে আর কোন মানে দাঁড়াবে না। তাই এখনই। কালকে আর এই গোটা শহরটায় কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না অপালাকে। শুধু অনেকগুলো ডাকনামের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ওদের বড় বাড়ি ,পাড়ার মোড় আর কলেজ স্ট্রীটের কিছু রাস্তারা। দিশাহারা এই শহরটা হঠাৎ করেই হয়ে যাবে সাদাকালো । আর ন্যাকাবোকা প্রেমের জন্য খিস্তি আর খিল্লি বরাদ্দ থাকবে মাঠের ধারে। 
এইসব কথাগুলো  বুঝতে হত অপালাকে। এইসব অনেক কথা যেগুলো আবির বোঝাতে চেয়েছিল, চাইছে। বুঝতে হত কিভাবে একটা মানুষের জীবন সাদাকালো হয়ে যায় অন্য মানুষটাকে ছাড়া। কিভাবে ডাকনামগুলো হয়ে যায় স্মৃতি আর কিভাবে প্রতিটা ব্যর্থ প্রেম হয়ে যায় ন্যাকা ইমোশন। এত কিছু বোঝার ছিল অপালার। এখন শুধু কথাগুলো থেকে যাবে। দামী কথাগুলো, নিজের জীবনের সবচেয়ে সত্যি কথাগুলো পরে থাকবে অপালার ইনবক্সে। seen না হয়ে, অবহেলায়। আর হলেও হয়তো উত্তর আসবে না কোনদিন। 

অপালা-

 এত বড় বাড়িটায় কোথাও আর কালকের পর ঘুরে বেড়ানো যাবে নাহ। নিজের ছোটবেলা, নিজেকে নিয়ে হারিয়ে যেতে হবে অন্য কোন শহরে। এই গোটা বাড়িটায় যেখানে মা চলে যাওয়ার পর সর্বত্র মা জড়িয়ে আছে, সেই মা কে ছেড়ে দিয়ে যেতে হবে এখানেই। এটাই কেউ বুঝতে পারছে না।দিদি ,বাবা সকলের কাছেই এখন ও শুধুমাত্র একটা দায়িত্ব। বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে সবদিক থেকে শান্তি। ও নিজেও বিয়ে করে নিতেই চায়। সিকিউরিটি দরকার এই ভাঙ্গা জীবনের। মা চলে যাওয়ার পর গোটা পৃথিবীটাই কেমন সাদাকালো। যেন মানুষটা রঙ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওর জীবনটা রঙিন করার জন্য। সব নিয়ে পালিয়ে গেছে বুড়ি। চারপাশের চেনা মানুষগুলোকেই। এখন লোকগুলো অনেক বেশি দায়িত্ববান। সহজ ব্যাপারটাই হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। এখন দিদি অনেক বেশি মা এর মতো হতে চায়।পারে না। চেষ্টা করে তবু।আর বাবা? যে  মানুষটা আগে অনেক সহজ ছিল এখন বিয়ে দেওয়ার জন্য প্রবলভাবে আগ্রহী। কোথাও একটা দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় ছিন্নমূল মনে হয়। এই এত বড় বাড়িটা, পুরনো জীবন, খুব সহজ সময়টা হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও। পুরনো অপালাই কি হারিয়ে যাচ্ছে না। এই ব্যাপারটা আবিরও বোঝে না। তবুও মনে হয় ওর অন্তত বোঝা উচিত ছিল। এত হারানোর মাঝে তাই আবিরও হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও। আর কদিন পর সিকিউরিটি দেওয়া ছেলের সাথে বিয়ে হলে পুরোপুরিই হয়তো হারিয়ে যাবে আবির। কিছু একটা কি থেকে যাবে? এই সময়গুলো, আবির ,ওর লেখা ইনবক্সের মেসেজ -কিছু কি থাকবে? জানে না অপালা।জানতে চায় ও না। ও শুধু শান্তি চায় এখন। নীরব, নিভৃত শান্তি। 

শেষ কিছু কথা- 

গোটা শহর পরে থাকে। পড়ে থাকে আবির,অপালা। তাদের তৈরি করা ডাকনামগুলো। ঝালমুড়ির ঠোঙ্গায় অথবা শেষ বিকেলের একসাথে হাঁটায় অনেকগুলো কথা  থেকে যায়। যেগুলো আর ওদের থেকে শুনতে পাবে না শহর। তবু ওরা কি থাকবে না কোথাও? এই শহরের বুকের থেকে হারিয়ে যাবে? তা নয়। ওরা থাকবে। ওরা থেকেই যায়।  হয়তো ওদের নাম এক হবে না। হয়তো ওদের গল্পে থাকবে না ভাংচুর। একটা মসৃণ রাস্তা ধরে ওরা আসবে গল্পের শেষে। তবু ওরা মরবে না। মরে নাহ। অন্তত শহর মরতে দেয় না ওদের...
                              

Saturday 8 February 2014

মরে যাওয়া রূপকথারা...

রোদ। অরিনের গায়ে বিকেলের রোদ । ট্রেন এর জানলার ধারের রোদটুকু ওকে ছেড়ে যেতে চাইছেনা কিছুতেই। ওর অবশ্য খারাপ লাগছে না। শীতকালের রোদ হলেও আলোটা বেশ নরম। কামরার অন্ধ গায়কের ''উঠগো  ভারত লক্ষ্মী'' র সাথে যাচ্ছে বেশ। অরিন যাবে অনেকদূর। ট্রেন , তারপর বাস। অনেকটা রাস্তা। রাজন্যার  বিয়ে। ওর নিমন্ত্রণ। রাজন্যা কে ? এই প্রশ্নটা অবশ্য থমকে দিতে পারে ওকে। প্রেমিকা অথবা বান্ধবী? উত্তরটা ও জানে না। অথবা বলা ভালো এই মুহূর্তে জানতে চায় নাহ। ও শুধুই নিমন্ত্রিত। যাকে কাকু, কাকিমা চেনেন। বন্ধু- বান্ধবরা চেনে। আর চেনে রাজন্যা। ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে থামে। পাশের কোন একটা রাস্তায় গান বাজছে। ভাষাটা পরিচিত নয়। অরিন জানে যেখানে গানটা বাজছে তার ঠিক সামনেই অনেক লোকে নাচছে। আনন্দে। কোন অনুষ্ঠান আছে হয়তো। না থাকলেই বা কি? ওরা আনন্দ করেই। ট্রেনটার পাশের একটা পাঁচিলে পাখি। কালো সাদা মিশিয়ে। খুব ডাকছে। ও কি আনন্দ করছে গানের তালের সাথে? নাকি খুঁজছে কাউকে? অরিন কি কাউকে খোঁজে এখনো? উত্তরটা মাথায় আসার আগেই ট্রেনটা আবার ঝাঁকুনি দেয়। চলতে শুরু করে। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে অনেকখানি নীল আকাশ। বড্ড বেশি নীল। মাঝে একটুখানি সাদা ভাঙ্গা একটা চাঁদ। সময় যায় আরও একটু। আকাশের গায়ে ছোপ লাগে কালো। গাড়ি বদলায়। বাস এর জানলায় বসে থাকা লোকটা অরিনকে কিছুতেই জানলার ধারে বসতে না দেওয়ায় ঝামেলা হয় খানিক। কাজ হয় না। অগত্যা লোকটার হাতের পাশ দিয়ে অরিন আকাশ দেখে। রাত ছাপ ফেলছে আকাশে ।আর একটা একটা করে আলোর বিন্দু ফুটে উঠছে  বড় ক্যানভাসটাতে। বিয়ের আগে রাজন্যা কেঁদেছিল। সব চলে যাচ্ছে বলে। মুহূর্তগুলোর জন্য কেঁদেছিল ও। তখন ওর কান্না থামাতে বড় কাজে এসেছিল এই বিন্দু গুলো। মনে আছে অরিনের এখনো। ওই তারাগুলোর থেকে নেমে আসে পরীরা। রাতের আকাশে তারারা আর পরীরা ভালবেসে থাকে একসঙ্গে। অত কান্না সত্ত্বেও রাজন্যাকে পরীর মতনই লাগছিল। নিজেকে কি তারা ভেবেছিল অরিন? বাস থামে। একটু হাঁটলে বিয়েবাড়ি। এই উত্তরটাও হারিয়ে যায় তাই। বিয়েবাড়ির মুখে বন্ধুরা ভিড় করে। বর আসেনি এখনো। এলোমেলো আলাপের পর আসে অনেকগুলো সিঁড়ি। এটা কি রূপকথার সিঁড়ি? যাতে চড়ে সোজা যাওয়া যায় তারাদের মাঝে? যেখানে পরীরা থাকে? সিঁড়ির নিচের গোলমালে এই উত্তরটাও হারিয়ে যায়। বর এসে গেছে। খানিকটা ব্যস্ততায় উপরে ওঠে অরিন। ভিড় ঠেলে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে একটা মুখ। একটু আশঙ্কা আর ভয় মেশানো। রূপকথার মতই সুন্দর। ওর চোখ কি খুঁজছে কাউকে? বোঝা যায় নাহ। বন্ধুদের একটা ভিড় অরিন কে ধরে নিয়ে চলে উপরে। যেখানে বিয়ে হবে। পরী অদৃশ্য হয়। চোখ বুজে ফেলে অরিন। বোধহয় মুখটাকে মনে রাখার জন্যই। পারে না বেশিক্ষণ। বিয়ে হয়। শুভদৃষ্টি, সাতপাক, সিঁদুরদান। অরিন চোখদুটো দেখে রাজন্যার। খানিকটা লাল, একটু ছলছলে। আর কেউ কি দেখেছে রাজন্যার চোখ? যারা বিয়ে দিচ্ছে, অথবা ঘরভরতি যারা তাকিয়ে আছে ওর দিকে,ক্যামেরার ফ্ল্যাশ- কেউ কি দেখছে এখন রাজন্যার চোখ? বোধহয় না। অরিন জানলার দিকে তাকায়। বড় একটা আকাশ আর অনেক তারা। চোখে কিছু পড়ে বোধহয়। নয়ত হঠাৎ ঝাপসা লাগে কেন? সব শেষ হয়। বাসরঘরে রাত জাগে অনেকে। অরিন ও জাগে। চেঁচামেচি,আনন্দ, হুল্লোড় শেষ রাত্তিরে থেমে যায়। ঘুমোয় সকলে। ঠাণ্ডা রাতের বারান্দায় অরিন জাগে। স্বপ্নের কথা ভাবে। যে স্বপ্নের কথা বলা হয়নি রাজন্যাকে। সেই স্বপ্ন। স্বপ্নে কোন এক বড় ঘাটের সিঁড়িতে বসে অরিন দেখে প্রচুর প্রদীপ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে জলে। গোটা ঘাট আলো। সেই আলোয় অরিন বসে থাকে।চুপচাপ। সময় কাটে। আস্তে আস্তে প্রদীপ ভেসে যায় আরও দুরে।ঘাটের আলো মিশে যায় অনেক দূরে আকাশের সাথে। আকাশে অনেক তারা। জ্বলজ্বল করে। ঘাটের ধারে বসে একলা লাগে খুব। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখে অরিন। অনেক তারার মাঝে খুঁজতে চায় কিছু। রূপকথার মত পরী নেমে  আসার কথাই ভাবে বোধহয়। পরী নেমেও আসে। পরীর মুখটা... নাহ। স্বপ্নটা আর বলা হবে নাহ রাজন্যাকে কোনদিন। ঘরে আসে অরিন। রাজন্যা জেগে আছে। একটা চেয়ারে বসে। মাথা নামানো। ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলে, ''অনেক রাত হল। আর কত জেগে থাকবি? শুয়ে পর এবার। '' অরিন তাকায়। হালকা লাল দুটো চোখ। চন্দন দিয়ে ঘেরা। ভাবে, রূপকথারা এভাবেই শেষ হয়ে যায় বোধহয়... 

Thursday 14 November 2013

এলোমেলো মুহূর্তেরা...

                                                                            

                                                                               ১
কোনও কোনও সময় মুগ্ধতা চলে যায়। যেটা পড়ে থাকে সেটাকে বিকেলবেলায় আমি ডাকতে শুনি। খুব কাছে,অথবা দূরে। যে বকুলগাছের তলায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা আমাকে অপমান করেছিল সেই বকুল গাছেরই মাঝামাঝি একটা ডালে বসে ওটা ডাকে। আরও মাসপাঁচেক আগেও ওটা ডাকত। তবে অন্যরকম। জিজ্ঞাসাকে নিয়ে গেছি অনেকবার ওখান দিয়ে। 'কি ডাকছে ?' প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি কখনো।আজ আমি জানি উত্তরটা। আমার আর উত্তরের মাঝখানে জিজ্ঞাসাই নেই শুধু...

                                                      ২
আধ খাওয়া সিগারেট হাত থেকে ফেলে আমাকে বলল স্যাণ্ডো- ' চ, কোথায় যাবি? ' যাওয়ার কথা ছিল না কোথাও। তবু জানি ও ছাড়বে না কিছুতেই। স্যাণ্ডো বড়লোকের ছেলে। বড় সিগারেট খায়। ফেলে আরও বেশি। গলির মোড়ে চায়ের দোকানে যে ছেলেটা বসে বাসন মাজে সে স্যাণ্ডোকে দেখলেই হাসিমুখে এসে দাঁড়ায়। স্যাণ্ডোর প্রসাদ পাবে বলে। ফেলে যাওয়া সিগারেটটা ও  কুড়োয়। টান মারে। মুখে একটা হাসি। আত্মতৃপ্তির???

                                                       ৩
মাঠের ধারের আড্ডার জায়গাটা এখন ফাঁকা। আগে ওখানে জমত অনেকে। সবাই ব্যস্ত এখন। ওখানে এখন শুধু আমি আর স্যাণ্ডো বসি। আমাদের কাজকম্ম নেই। প্রতিদিন রাতে আড্ডা ব্যাপারটা চলে গেছে বন্ধুদের মধ্যে থেকে। শুধু আমরা দুজন এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি। আমাদের প্রথা। আড্ডা বাঙ্গালির অহংকার বলে কি?  আসলে তা নয়। আসল কথা আমরা দুজন প্রায় হেরে যাওয়া মানুষ প্রতিদিন এখানে আসি। বসি। বোধহয় বাকিদের জীবন কতোটা এগিয়ে গেছে সেটা বুঝতেই। তবু এগিয়ে যেতে পারি নাহ। দৌড়তেও...

                                                         ৪
জিজ্ঞাসা আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল। প্রধান কারণ আমি জীবনে উন্নতি করতে পারব নাহ। জিজ্ঞাসাকে আমি ছাড়তে পারিনি। কেন ছাড়িনি এই প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসাও দিতে পারবে নাহ। আমিও। বন্ধুরা প্রশ্নটা করেছে বহুবার। প্রতিবার আমি চুপ থেকেছি।এখন আমি নীরবতাও মেপে খরচা করি। অনেক গরীব হয়ে গেছি ,তাই হয়তো। জিজ্ঞাসা আমাকে প্রশ্ন করত। অনেক। মাথা খারাপ করে দিত। জিজ্ঞাসা বন্ধুদের মত এই প্রশ্নটা করেনি। কেন? ও কি কারণ জানত? নাকি ও কোনও কারণই জানতে চাইত না?  আমিই বা কি চাইতাম? এতদিন পরে দাঁড়িয়ে বুঝি ও যদি প্রশ্নটা করত তাহলে আমি হয়তো চেষ্টা করতাম বলার। হয়তো ভুল বলতাম। তবু বলতাম। অন্তত চেষ্টা করতাম।

                                                          ৫
অন্ধকার রাস্তাটা সোজা গেছে। মিশেছে ল্যাম্পপোস্টের আলোর সাথে। বৃষ্টি পড়ছিল কদিন আগেও। রুমকিদের বাড়ির খোলা বারান্দায় ঝোলানো প্রিজমে আলো লেগে রাস্তাটা ডিস্কোথেক হয়ে গেছে । সেই আলোর মাঝে রুমকির বাবা প্রায় নাচতে নাচতে রাস্তার গর্তগুলো পেরিয়ে যাচ্ছেন। ছাইরঙা প্যান্টে খানিক কাদার ছাপ।  এ পাড়ার গলিগুলো রুমকি চিনিয়েছিল আমায়। খেলনা ঘড়ির প্লাস্টিকে রাস্তার আলোটা খেলা করত আর প্রিজম ঝোলানো বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুমকি আমাকে জানাত ওর খবর। আমাকে কাদামাখা রাস্তা পেরোতে দেখত আর হাসত। বাচ্ছাদের মত। অথবা ওর নিজেরই মত। ওর একটা হাসি ছিল। সকলেরই যেমন থাকে, ঠিক তেমন নয়। তাই হাসলে আলাদা লাগত ওকে। হাসিতেই বোঝা যেত ওর মন। কখনো গলিটা ভরে যেত রোদে, কখনো বা মনখারাপের মেঘে। মাঝে দাঁড়িয়ে আমি ভিজতাম। বৃষ্টিতে , রোদে । বেশ লাগত। আমার নিজের আবহাওয়া দপ্তর ছিল। তাই হয়তো...

                                                            ৬
এখন শীতের শুকনো গলিতে অনেকখানি কুয়াশা ভরা থাকে সকালের দিকে। গর্তগুলো আর নেই। ছেঁড়া পকেটের তাপ্পির মত বুজে গেছে বেমালুম। রুমকিদের বাড়ির খোলা বারান্দায় রোদ খেলা করে আজও। রুমকি থাকে না আর। আবহাওয়া দপ্তরের খবরও আজকাল আর আসে না আমার কাছে। শুনেছি ওর বিয়ে হয়েছে। খারাপ লাগে আমার। চাকরিটা চলে যাওয়ার জন্যই। গলিগুলো আছে। গলিগুলো থেকে যায়। ঠিক রুমকির চেনানোর মতই। আমিও হাঁটি। ঠিক আগেকার মতই। শুধু পা পিছলে পড়ার ভয় থাকে কম। গর্তগুলো বুজে যাওয়ার জন্যই বোধহয়। নিজের মনে হাসি অকারণ। আর ভাবি মনখারাপ মিশে বেশ রোদের জোর বেড়ে যায়...