Sunday 28 October 2012

তোমাকে বাবা...


কোন এক রাতে তুমুল আড্ডার মাঝে মনখারাপের সুরে ছেলেটা

বলেছিল,''জানিস আমার বাবা নেই।'' জীবনে আর কোনদিন ওকে

এই নিয়ে আক্ষেপ করতে দেখিনি। কখনো নয়। হাসিতে ওর কখনো

টান পড়েনি। আমাদের মত মুহূর্ত বেছে নিয়ে হাসত না ও। বরং ওর

হাসিগুলোই অনেক মুহূর্তের জন্ম দিত। সেই রাতে অদ্ভুত ভাবে চুপ

ছিলাম আমি। এই কথার পরে। আমার কোন কথা ওর অতীত

খুঁড়েছিল জানতে চাইনি। জানতে চাইনি আগের বা পরের ঘটনা।

শুধু চুপ ছিলাম। নীরবতা ওকে সুস্থ করেছিল। হাসিতে ফিরিয়ে

এনেছিল। শুধু ওর মনখারাপের নাম জানিয়েছিল আমায়।


ওর বাড়ির অবস্থা আমি জানতাম। খুব ভাল কিছু ছিল নাহ। তবু

কাকিমা যখন হোস্টেলে আসতেন আমার জন্য কিছু না কিছু

থাকতই। আমিও লোভ ছাড়তে পারিনি কোনদিন। কাকিমার হাতের

হাতের তৈরি পোস্তর টানেই ঘরে ফিরতাম না খেলেই। কার বাড়ির

কুকুর কত বড় হল। কে কাকে কি নামে ডাকে পাড়ায়। এইসব।

না জানতে চেয়েও ওর গোটা পাড়ার লোকজনকে আমি মুখস্থ করে

ফেলেছিলাম। এইসব গল্পের মাঝে ও আসতো নাহ। একটু দূরে বসে

লক্ষ্য করত আমাদের। কাকিমাও ওকে ডাকতেন নাহ। আমার সাথে

গল্প করেই বেরিয়ে যেতেন। ওদের দূরত্ব আমাকে ভয় দেখাতো। কিন্তু

তা নিয়ে ওকে কোনদিন ভয় পেতে দেখিনি।


ওর বাড়িতে দু-একবার গেছি। নিজের বাড়ি নয়। কাকা বা মাসি, কার

একটা বাড়িতে থাকতো কলকাতায় থাকলে। সেই বাড়িতে। তারাও

খুব হাসতেন। আমি বুঝতাম ও নিজের হাসি কোথা থেকে পেয়েছে।

ওর প্রিয় জিনিসপত্রের ভিড়ে আমরা হারিয়ে যেতাম খানিকক্ষণ।

হাজারগণ্ডা পুরনো বই। কিছু পুরনো খেলার জিনিস। আর বেশ কিছু

খাতা। খানিকক্ষণ আমি হারিয়ে যেতাম ওর থেকে। নিজেকে খুঁজে

নিত ও এসবের মধ্যে। নিজের মতন করে।


আরেকটা জিনিস ওর খুব প্রিয় ছিল। খুব পুরনো কোণা ভাঙ্গা একটা 


স্লেট। সেটা কাউকে ছুঁতে দিত না কিছুতেই। চেষ্টা করে দেখেছি

অনেকবার। ওকে রাগাতেই। সফলও হয়েছি প্রতিবারে। তবু ও ছুঁতে

দেয়নি আমায়। অনেক পরে জেনেছিলাম,ওর বাবা ওর মাথার কাছে 


স্লেটটা ঝুলিয়ে রাখতেন। আর প্রতিদিন রাতে ওর ঘুমনোর পর একটা

কিছু লিখে যেতেন। ঘুমের মধ্যে ও কলম্বাস হয়ে আমেরিকা খুঁজে

পেত ঘুম ভাঙ্গার পর। ছেলেবেলার বন্দী মুহূর্তগুলোকে ও কারো কাছে

মুক্ত করতে রাজি ছিল নাহ। নিজের কাছে ছাড়া।


ও গল্প লিখত। কবিতাও। তাতে ওর বাবার কথা ছিল নাহ। ওর 


বাবাকে ও খুব যত্নে রাখত। মনের ভিতর। একদিন দেখেছিলাম ও

বড় একটা পাতায় কিসব লিখছে। গল্প ভেবে গিয়েছিলাম। পড়তে

দেয়নি। শুধু শেষের দুটো শব্দ ছিল, ''তোমাকে বাবা...''


তখন বুঝেছিলাম ও কেন বাবার কথা বলে নাহ। ও কেন বাবাকে

আর খোঁজে নাহ। কারণ ও ওনাকে সাজিয়ে রেখেছে, ওর লেখা আর

হাজার লেখা চিঠির ভিতর। যার সবকটার শেষেই লেখা আছে,

''তোমাকে বাবা...''

Saturday 13 October 2012

আত্মহত্যা বা মৃত্যুবলয়

আমার স্বপ্ন, আমার কবিতা, ছেঁড়া পাতায় খেলা কাটাকুটি - সব পড়ে আছে একপাশে।আর একপাশে আমি নিজে। খুব রোদে পুড়ে যাওয়া গাছের পাতার সাথে কথা বলে দেখা গেছে ওরা পুড়েছিল পোড়ার আনন্দে। বিশেষ কিছু পেতে চায়নি। ট্রাম লাইনের ধারে পড়ে থাকা একলা রোদটাও বৃষ্টি ভিজেছিল। ভিজতে ভাল লেগেছিল বলে। আত্মহত্যাও বোধহয় এই ধরনের ভাললাগা। ভালবাসাও বলা চলে। শুধু সেটা জীবনের প্রতি না হয়ে বিপরীতমুখীই হয় বারবার। আত্মহত্যা  মানে শূন্য। একটা লোক আত্মহত্যা করল। ইকুয়েশন  করলে দাঁড়াবে সেই লোকটি = ০ ।
আত্মহত্যা বললেই আমার জীবনানন্দকে মনে পড়ে। কেন পড়ে? উত্তর দেওয়াটা খুব মুশকিল। তবু পড়ে। ট্রামলাইনের বুকে পড়ে থাকা রোদ আর জীবনানন্দের বিখ্যাত মুখটি ভেসে ওঠে। আত্মহত্যা একটা ঘটনা, দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া,চরমতম সিদ্ধান্ত। ইচ্ছাও বলা চলে একে অনায়াসে। হয়তো প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হয়ে ঘরে ফেরার লড়াই থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। সুখ যদি বলি একে তাহলে , নিজের মত করে জীবনটাকে বাঁচতে না পেরে অন্তত নিজের মত করে মরার সুখ। চরিত্ররা আত্মহত্যা করে প্রতিদিন ,প্রতিমুহূর্তে। আমরা আত্মহত্যা করি। রোদ- ঝড় - জলের এ শহরে নিজেদের কত ইচ্ছেকে কবর দিই নিজেরাই। ছেঁড়া পাতায়, কাটাকুটি করে লেখা কিছু কথায় কত স্বপ্ন হারিয়ে যায় প্রতিদিন। আমরা হারাই। হারিয়ে যেতে দিই। নিজেদের মুছে ফেলি আস্তে আস্তে। শান্ত হাতে। মনে মনে। আর যারা এই মোছার কাজটা মনে মনে করেন না, তারাই চরিত্র হয়ে ওঠেন এপাড়া বা বেপাড়ার গল্পের। স্মৃতির শোকমিছিলের পদাতিক তারা হাঁটতে থাকেন একসাথে। গায়ে অপঘাতের দাগ নিয়ে।...