কোন এক রাতে তুমুল আড্ডার মাঝে মনখারাপের সুরে ছেলেটা
বলেছিল,''জানিস আমার বাবা নেই।'' জীবনে আর কোনদিন ওকে
এই নিয়ে আক্ষেপ করতে দেখিনি। কখনো নয়। হাসিতে ওর কখনো
টান পড়েনি। আমাদের মত মুহূর্ত বেছে নিয়ে হাসত না ও। বরং ওর
হাসিগুলোই অনেক মুহূর্তের জন্ম দিত। সেই রাতে অদ্ভুত ভাবে চুপ
ছিলাম আমি। এই কথার পরে। আমার কোন কথা ওর অতীত
খুঁড়েছিল জানতে চাইনি। জানতে চাইনি আগের বা পরের ঘটনা।
শুধু চুপ ছিলাম। নীরবতা ওকে সুস্থ করেছিল। হাসিতে ফিরিয়ে
এনেছিল। শুধু ওর মনখারাপের নাম জানিয়েছিল আমায়।
ওর বাড়ির অবস্থা আমি জানতাম। খুব ভাল কিছু ছিল নাহ। তবু
কাকিমা যখন হোস্টেলে আসতেন আমার জন্য কিছু না কিছু
থাকতই। আমিও লোভ ছাড়তে পারিনি কোনদিন। কাকিমার হাতের
হাতের তৈরি পোস্তর টানেই ঘরে ফিরতাম না খেলেই। কার বাড়ির
কুকুর কত বড় হল। কে কাকে কি নামে ডাকে পাড়ায়। এইসব।
না জানতে চেয়েও ওর গোটা পাড়ার লোকজনকে আমি মুখস্থ করে
ফেলেছিলাম। এইসব গল্পের মাঝে ও আসতো নাহ। একটু দূরে বসে
লক্ষ্য করত আমাদের। কাকিমাও ওকে ডাকতেন নাহ। আমার সাথে
গল্প করেই বেরিয়ে যেতেন। ওদের দূরত্ব আমাকে ভয় দেখাতো। কিন্তু
তা নিয়ে ওকে কোনদিন ভয় পেতে দেখিনি।
ওর বাড়িতে দু-একবার গেছি। নিজের বাড়ি নয়। কাকা বা মাসি, কার
একটা বাড়িতে থাকতো কলকাতায় থাকলে। সেই বাড়িতে। তারাও
খুব হাসতেন। আমি বুঝতাম ও নিজের হাসি কোথা থেকে পেয়েছে।
ওর প্রিয় জিনিসপত্রের ভিড়ে আমরা হারিয়ে যেতাম খানিকক্ষণ।
হাজারগণ্ডা পুরনো বই। কিছু পুরনো খেলার জিনিস। আর বেশ কিছু
খাতা। খানিকক্ষণ আমি হারিয়ে যেতাম ওর থেকে। নিজেকে খুঁজে
নিত ও এসবের মধ্যে। নিজের মতন করে।
আরেকটা জিনিস ওর খুব প্রিয় ছিল। খুব পুরনো কোণা ভাঙ্গা একটা
স্লেট। সেটা কাউকে ছুঁতে দিত না কিছুতেই। চেষ্টা করে দেখেছি
অনেকবার। ওকে রাগাতেই। সফলও হয়েছি প্রতিবারে। তবু ও ছুঁতে
দেয়নি আমায়। অনেক পরে জেনেছিলাম,ওর বাবা ওর মাথার কাছে
স্লেটটা ঝুলিয়ে রাখতেন। আর প্রতিদিন রাতে ওর ঘুমনোর পর একটা
কিছু লিখে যেতেন। ঘুমের মধ্যে ও কলম্বাস হয়ে আমেরিকা খুঁজে
পেত ঘুম ভাঙ্গার পর। ছেলেবেলার বন্দী মুহূর্তগুলোকে ও কারো কাছে
মুক্ত করতে রাজি ছিল নাহ। নিজের কাছে ছাড়া।
ও গল্প লিখত। কবিতাও। তাতে ওর বাবার কথা ছিল নাহ। ওর
বাবাকে ও খুব যত্নে রাখত। মনের ভিতর। একদিন দেখেছিলাম ও
বড় একটা পাতায় কিসব লিখছে। গল্প ভেবে গিয়েছিলাম। পড়তে
দেয়নি। শুধু শেষের দুটো শব্দ ছিল, ''তোমাকে বাবা...''
তখন বুঝেছিলাম ও কেন বাবার কথা বলে নাহ। ও কেন বাবাকে
আর খোঁজে নাহ। কারণ ও ওনাকে সাজিয়ে রেখেছে, ওর লেখা আর
হাজার লেখা চিঠির ভিতর। যার সবকটার শেষেই লেখা আছে,
''তোমাকে বাবা...''