Thursday 14 November 2013

এলোমেলো মুহূর্তেরা...

                                                                            

                                                                               ১
কোনও কোনও সময় মুগ্ধতা চলে যায়। যেটা পড়ে থাকে সেটাকে বিকেলবেলায় আমি ডাকতে শুনি। খুব কাছে,অথবা দূরে। যে বকুলগাছের তলায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা আমাকে অপমান করেছিল সেই বকুল গাছেরই মাঝামাঝি একটা ডালে বসে ওটা ডাকে। আরও মাসপাঁচেক আগেও ওটা ডাকত। তবে অন্যরকম। জিজ্ঞাসাকে নিয়ে গেছি অনেকবার ওখান দিয়ে। 'কি ডাকছে ?' প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি কখনো।আজ আমি জানি উত্তরটা। আমার আর উত্তরের মাঝখানে জিজ্ঞাসাই নেই শুধু...

                                                      ২
আধ খাওয়া সিগারেট হাত থেকে ফেলে আমাকে বলল স্যাণ্ডো- ' চ, কোথায় যাবি? ' যাওয়ার কথা ছিল না কোথাও। তবু জানি ও ছাড়বে না কিছুতেই। স্যাণ্ডো বড়লোকের ছেলে। বড় সিগারেট খায়। ফেলে আরও বেশি। গলির মোড়ে চায়ের দোকানে যে ছেলেটা বসে বাসন মাজে সে স্যাণ্ডোকে দেখলেই হাসিমুখে এসে দাঁড়ায়। স্যাণ্ডোর প্রসাদ পাবে বলে। ফেলে যাওয়া সিগারেটটা ও  কুড়োয়। টান মারে। মুখে একটা হাসি। আত্মতৃপ্তির???

                                                       ৩
মাঠের ধারের আড্ডার জায়গাটা এখন ফাঁকা। আগে ওখানে জমত অনেকে। সবাই ব্যস্ত এখন। ওখানে এখন শুধু আমি আর স্যাণ্ডো বসি। আমাদের কাজকম্ম নেই। প্রতিদিন রাতে আড্ডা ব্যাপারটা চলে গেছে বন্ধুদের মধ্যে থেকে। শুধু আমরা দুজন এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি। আমাদের প্রথা। আড্ডা বাঙ্গালির অহংকার বলে কি?  আসলে তা নয়। আসল কথা আমরা দুজন প্রায় হেরে যাওয়া মানুষ প্রতিদিন এখানে আসি। বসি। বোধহয় বাকিদের জীবন কতোটা এগিয়ে গেছে সেটা বুঝতেই। তবু এগিয়ে যেতে পারি নাহ। দৌড়তেও...

                                                         ৪
জিজ্ঞাসা আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল। প্রধান কারণ আমি জীবনে উন্নতি করতে পারব নাহ। জিজ্ঞাসাকে আমি ছাড়তে পারিনি। কেন ছাড়িনি এই প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসাও দিতে পারবে নাহ। আমিও। বন্ধুরা প্রশ্নটা করেছে বহুবার। প্রতিবার আমি চুপ থেকেছি।এখন আমি নীরবতাও মেপে খরচা করি। অনেক গরীব হয়ে গেছি ,তাই হয়তো। জিজ্ঞাসা আমাকে প্রশ্ন করত। অনেক। মাথা খারাপ করে দিত। জিজ্ঞাসা বন্ধুদের মত এই প্রশ্নটা করেনি। কেন? ও কি কারণ জানত? নাকি ও কোনও কারণই জানতে চাইত না?  আমিই বা কি চাইতাম? এতদিন পরে দাঁড়িয়ে বুঝি ও যদি প্রশ্নটা করত তাহলে আমি হয়তো চেষ্টা করতাম বলার। হয়তো ভুল বলতাম। তবু বলতাম। অন্তত চেষ্টা করতাম।

                                                          ৫
অন্ধকার রাস্তাটা সোজা গেছে। মিশেছে ল্যাম্পপোস্টের আলোর সাথে। বৃষ্টি পড়ছিল কদিন আগেও। রুমকিদের বাড়ির খোলা বারান্দায় ঝোলানো প্রিজমে আলো লেগে রাস্তাটা ডিস্কোথেক হয়ে গেছে । সেই আলোর মাঝে রুমকির বাবা প্রায় নাচতে নাচতে রাস্তার গর্তগুলো পেরিয়ে যাচ্ছেন। ছাইরঙা প্যান্টে খানিক কাদার ছাপ।  এ পাড়ার গলিগুলো রুমকি চিনিয়েছিল আমায়। খেলনা ঘড়ির প্লাস্টিকে রাস্তার আলোটা খেলা করত আর প্রিজম ঝোলানো বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুমকি আমাকে জানাত ওর খবর। আমাকে কাদামাখা রাস্তা পেরোতে দেখত আর হাসত। বাচ্ছাদের মত। অথবা ওর নিজেরই মত। ওর একটা হাসি ছিল। সকলেরই যেমন থাকে, ঠিক তেমন নয়। তাই হাসলে আলাদা লাগত ওকে। হাসিতেই বোঝা যেত ওর মন। কখনো গলিটা ভরে যেত রোদে, কখনো বা মনখারাপের মেঘে। মাঝে দাঁড়িয়ে আমি ভিজতাম। বৃষ্টিতে , রোদে । বেশ লাগত। আমার নিজের আবহাওয়া দপ্তর ছিল। তাই হয়তো...

                                                            ৬
এখন শীতের শুকনো গলিতে অনেকখানি কুয়াশা ভরা থাকে সকালের দিকে। গর্তগুলো আর নেই। ছেঁড়া পকেটের তাপ্পির মত বুজে গেছে বেমালুম। রুমকিদের বাড়ির খোলা বারান্দায় রোদ খেলা করে আজও। রুমকি থাকে না আর। আবহাওয়া দপ্তরের খবরও আজকাল আর আসে না আমার কাছে। শুনেছি ওর বিয়ে হয়েছে। খারাপ লাগে আমার। চাকরিটা চলে যাওয়ার জন্যই। গলিগুলো আছে। গলিগুলো থেকে যায়। ঠিক রুমকির চেনানোর মতই। আমিও হাঁটি। ঠিক আগেকার মতই। শুধু পা পিছলে পড়ার ভয় থাকে কম। গর্তগুলো বুজে যাওয়ার জন্যই বোধহয়। নিজের মনে হাসি অকারণ। আর ভাবি মনখারাপ মিশে বেশ রোদের জোর বেড়ে যায়...

No comments:

Post a Comment