Saturday 8 February 2014

মরে যাওয়া রূপকথারা...

রোদ। অরিনের গায়ে বিকেলের রোদ । ট্রেন এর জানলার ধারের রোদটুকু ওকে ছেড়ে যেতে চাইছেনা কিছুতেই। ওর অবশ্য খারাপ লাগছে না। শীতকালের রোদ হলেও আলোটা বেশ নরম। কামরার অন্ধ গায়কের ''উঠগো  ভারত লক্ষ্মী'' র সাথে যাচ্ছে বেশ। অরিন যাবে অনেকদূর। ট্রেন , তারপর বাস। অনেকটা রাস্তা। রাজন্যার  বিয়ে। ওর নিমন্ত্রণ। রাজন্যা কে ? এই প্রশ্নটা অবশ্য থমকে দিতে পারে ওকে। প্রেমিকা অথবা বান্ধবী? উত্তরটা ও জানে না। অথবা বলা ভালো এই মুহূর্তে জানতে চায় নাহ। ও শুধুই নিমন্ত্রিত। যাকে কাকু, কাকিমা চেনেন। বন্ধু- বান্ধবরা চেনে। আর চেনে রাজন্যা। ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে থামে। পাশের কোন একটা রাস্তায় গান বাজছে। ভাষাটা পরিচিত নয়। অরিন জানে যেখানে গানটা বাজছে তার ঠিক সামনেই অনেক লোকে নাচছে। আনন্দে। কোন অনুষ্ঠান আছে হয়তো। না থাকলেই বা কি? ওরা আনন্দ করেই। ট্রেনটার পাশের একটা পাঁচিলে পাখি। কালো সাদা মিশিয়ে। খুব ডাকছে। ও কি আনন্দ করছে গানের তালের সাথে? নাকি খুঁজছে কাউকে? অরিন কি কাউকে খোঁজে এখনো? উত্তরটা মাথায় আসার আগেই ট্রেনটা আবার ঝাঁকুনি দেয়। চলতে শুরু করে। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে অনেকখানি নীল আকাশ। বড্ড বেশি নীল। মাঝে একটুখানি সাদা ভাঙ্গা একটা চাঁদ। সময় যায় আরও একটু। আকাশের গায়ে ছোপ লাগে কালো। গাড়ি বদলায়। বাস এর জানলায় বসে থাকা লোকটা অরিনকে কিছুতেই জানলার ধারে বসতে না দেওয়ায় ঝামেলা হয় খানিক। কাজ হয় না। অগত্যা লোকটার হাতের পাশ দিয়ে অরিন আকাশ দেখে। রাত ছাপ ফেলছে আকাশে ।আর একটা একটা করে আলোর বিন্দু ফুটে উঠছে  বড় ক্যানভাসটাতে। বিয়ের আগে রাজন্যা কেঁদেছিল। সব চলে যাচ্ছে বলে। মুহূর্তগুলোর জন্য কেঁদেছিল ও। তখন ওর কান্না থামাতে বড় কাজে এসেছিল এই বিন্দু গুলো। মনে আছে অরিনের এখনো। ওই তারাগুলোর থেকে নেমে আসে পরীরা। রাতের আকাশে তারারা আর পরীরা ভালবেসে থাকে একসঙ্গে। অত কান্না সত্ত্বেও রাজন্যাকে পরীর মতনই লাগছিল। নিজেকে কি তারা ভেবেছিল অরিন? বাস থামে। একটু হাঁটলে বিয়েবাড়ি। এই উত্তরটাও হারিয়ে যায় তাই। বিয়েবাড়ির মুখে বন্ধুরা ভিড় করে। বর আসেনি এখনো। এলোমেলো আলাপের পর আসে অনেকগুলো সিঁড়ি। এটা কি রূপকথার সিঁড়ি? যাতে চড়ে সোজা যাওয়া যায় তারাদের মাঝে? যেখানে পরীরা থাকে? সিঁড়ির নিচের গোলমালে এই উত্তরটাও হারিয়ে যায়। বর এসে গেছে। খানিকটা ব্যস্ততায় উপরে ওঠে অরিন। ভিড় ঠেলে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে একটা মুখ। একটু আশঙ্কা আর ভয় মেশানো। রূপকথার মতই সুন্দর। ওর চোখ কি খুঁজছে কাউকে? বোঝা যায় নাহ। বন্ধুদের একটা ভিড় অরিন কে ধরে নিয়ে চলে উপরে। যেখানে বিয়ে হবে। পরী অদৃশ্য হয়। চোখ বুজে ফেলে অরিন। বোধহয় মুখটাকে মনে রাখার জন্যই। পারে না বেশিক্ষণ। বিয়ে হয়। শুভদৃষ্টি, সাতপাক, সিঁদুরদান। অরিন চোখদুটো দেখে রাজন্যার। খানিকটা লাল, একটু ছলছলে। আর কেউ কি দেখেছে রাজন্যার চোখ? যারা বিয়ে দিচ্ছে, অথবা ঘরভরতি যারা তাকিয়ে আছে ওর দিকে,ক্যামেরার ফ্ল্যাশ- কেউ কি দেখছে এখন রাজন্যার চোখ? বোধহয় না। অরিন জানলার দিকে তাকায়। বড় একটা আকাশ আর অনেক তারা। চোখে কিছু পড়ে বোধহয়। নয়ত হঠাৎ ঝাপসা লাগে কেন? সব শেষ হয়। বাসরঘরে রাত জাগে অনেকে। অরিন ও জাগে। চেঁচামেচি,আনন্দ, হুল্লোড় শেষ রাত্তিরে থেমে যায়। ঘুমোয় সকলে। ঠাণ্ডা রাতের বারান্দায় অরিন জাগে। স্বপ্নের কথা ভাবে। যে স্বপ্নের কথা বলা হয়নি রাজন্যাকে। সেই স্বপ্ন। স্বপ্নে কোন এক বড় ঘাটের সিঁড়িতে বসে অরিন দেখে প্রচুর প্রদীপ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে জলে। গোটা ঘাট আলো। সেই আলোয় অরিন বসে থাকে।চুপচাপ। সময় কাটে। আস্তে আস্তে প্রদীপ ভেসে যায় আরও দুরে।ঘাটের আলো মিশে যায় অনেক দূরে আকাশের সাথে। আকাশে অনেক তারা। জ্বলজ্বল করে। ঘাটের ধারে বসে একলা লাগে খুব। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখে অরিন। অনেক তারার মাঝে খুঁজতে চায় কিছু। রূপকথার মত পরী নেমে  আসার কথাই ভাবে বোধহয়। পরী নেমেও আসে। পরীর মুখটা... নাহ। স্বপ্নটা আর বলা হবে নাহ রাজন্যাকে কোনদিন। ঘরে আসে অরিন। রাজন্যা জেগে আছে। একটা চেয়ারে বসে। মাথা নামানো। ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলে, ''অনেক রাত হল। আর কত জেগে থাকবি? শুয়ে পর এবার। '' অরিন তাকায়। হালকা লাল দুটো চোখ। চন্দন দিয়ে ঘেরা। ভাবে, রূপকথারা এভাবেই শেষ হয়ে যায় বোধহয়... 

7 comments:

  1. darun... darun... khub bhalo likhechis re... tor lekhay somoy jno jibonto hye othe... :)

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. Arin na Anir ? Dujon eki ? Naki Anir er modhye ekta Arin achhe ?
    Rajonya'ra ebhabei chondon ghera chokh niye Arin'der swopne bNeche thake. "Swopne boro ekta akash aar ekta tara" .. aha! khub sundor likhechis !

    ReplyDelete
  4. sob anir der moddhei arin thake bodhhoy...tai arin er kache amar kono rin nei... @itnakarvus

    ReplyDelete