Thursday 25 February 2016

ইচ্ছে হয় তাই...

                                    

বেঁকে থাকা চেয়ারটার মাথার উপরে ঘড়িটা এগিয়ে চলেছে নিজের মতন।ও থামতে জানে না, অন্তত অনেকদিন থামেনি। কাল রাতে মারা গিয়েছিল যারা ,সেসব সিগারেটের মৃতদেহ ছাইয়ের থেকে মুখ বাড়িয়ে আছে ।ওরা মরতে  চেয়েছিল কিনা সেসব কেউ জানতে চায়নি। জানতে চায় না। ওদের খুনিরা এখন ঘুমোচ্ছে। কেউ খাটে , কেউ বা মেঝেতে। সকলের মুখেই ছেলেমানুষি লেগে আছে। ওরা স্বপ্ন দেখছে। নতুন বা পুরনো স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পরে ওদের এই ঘুমনোটাও স্মৃতি হয়ে যাবে। তখনও এভাবেই ঘুমের মধ্যে হাসাতে আসবে কি এই মুহূর্তটাও ?
                                                    ১
সমুদ্র ওদের ডেকেছিল । সপ্তাহখানেক আগে। বিরাট গর্জনের সাথে ঠাণ্ডা হাওয়া মিশিয়ে জানিয়েছিল স্বাগত। কটেজের নরম আলোয় মেশা রাত আর পুকুরপাড়ের BONFIRE- এ গাওয়া গান জানিয়ে দিচ্ছিল ওদের যে জীবনটা এতোটা কঠিনও নয়। যতটা ওরা ভাবে। হ্যাঁ। চেষ্টা করে ওরাও নিজেদের মত সবকিছু সহজ করে নিতে। কিন্তু নিজেদের শহর ছেড়ে দূরে এসে সেই চেষ্টাটুকুও করতে হচ্ছে না আর। 'কাকতাড়ুয়া'ই হোক অথবা 'গুলাবি আঁখে' সবেতেই ওরা খুঁজে নিচ্ছে আনন্দের পথ। রাতজাগা গল্পগুলোতে পড়ে থাকছে অনেক পুরনো- নতুন কথা, আনন্দ হাসিঠাট্টা । জানাতে হচ্ছে না কষ্ট করে আমরা বেঁচে আছি।  এলোমেলো ঝাঁপে আর সমুদ্রের সাথে লড়াইতে পরের দিন বোঝা যাচ্ছিল জলটা নোনতা, ওরা নয়। তাই দু আঙ্গুল জলে ঝাপিয়ে কেউ উঠছিল জলদৈত্য সেজে খাবি খেতে খেতে , আবার কেউ একটু বেশি জলে ঝাপিয়ে দেখছিল কিভাবে ঢেউয়েরা মাথার উপর দিয়ে পালায়। একজন এসব কিছু থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, না না খুঁজছিল কিছু। কাউকে বুঝতে না দিয়ে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখছিল বাকিদের। মনে পড়ছিল আরও একজোড়া পায়ের কথা। যে জোড়া হেঁটেছিল ওর সাথে সমুদ্রের পাড়ে অনেকক্ষণ । হাত ধরে বুঝিয়েছিল এই যে জলগুলো ফিরে যাচ্ছে আবার সমুদ্রে , এরা মুছে দিতে পারবেনা ওদের পায়ের ছাপ। খুব ইচ্ছা করছিল বালি খুড়ে দেখতে ।এখনো কোথাও কি থেকে যেতে পারেনা ছাপগুলো ? এই জলগুলো হয়তো জানে ।জলের দিকে এগোতে এগোতে দেখল সবাই ডাকছে। এবার ছবি তোলার পালা একসাথে। শুনেছিল সমুদ্র কিছু নেয় না, ফিরিয়ে দেয়। ঐ দুটো পায়ের ছাপ নিয়ে এতগুলো পায়ের ছাপ ওর জন্য নিয়ে এসেছে তাই ? কিন্তু আরও একটু উদার হতে কি পারতো না সমুদ্র ? হারিয়ে যাওয়া হাসিটা আবার ফেরত এল মুখে । নাকি মুখোশটা হেসে উঠলো আবার ? জানা গেল  না এতটুকু...

                                                        ২
নোনাজলগুলো শুকিয়ে গিয়েছে বেশ কিছুদিন।ছবিগুলো স্মৃতি হয়ে যেতে বসেছে। হালকা হয়ে আসছে পাগলামিরা , আর জীবন গলার দড়িটা টেনে ধরেছে খুব জোরে। দাগ বসে যাচ্ছে অকারণ। আকাশটা দুদিনের জন্য বড় হয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে হঠাৎ কমে গেলে পরিধিটা ভালো লাগে না মোটেও। এই সত্যিটা বুঝতে বুঝতে ওরা ঠিক করল স্মৃতিগুলোকে হালকা হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। কারণ হালকা হলেই মিলিয়ে যায় সব তাড়াতাড়ি। কর্পূরের মতই উবে যায় বলা চলে। তাই ঠিক হল আকাশ না বানাতে পারলেও ওরা ভেবে নেবে আকাশ আছে। বেশ দিব্যি বড় একটা আকাশ । হালকা আলোয় মোড়া এই মিথ্যে কথার শহরে যেটার খুব প্রয়োজন। আর প্রয়োজন জীবন থেকে যেটা হারিয়ে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি সেই আনন্দ নামক বস্তুটিকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনা। শুরুটা খুব দ্রুতগামী। দুজন ছেলে ভোরের আলো গায়ে মেখে বেরিয়ে পড়ল বাইকে। আশেপাশের অনেক ছোটবড়  দাবীকে অনায়াসে পাশ কাটিয়ে একটা ছোট শহর থেকে বাইকটা ঢুকে পড়ল একটা বড় শহরে। তিলোত্তমায়। বাইকওয়ালার ফ্ল্যাট  আগেও দেখেছে ওদের। আজকে দেখেও বুঝতে পারল নরক গুলজার হতে চলেছে। জানা গেল পাপের ভাগীদাররা কেউ পৌছবে না অত সকালে। কেউ রক্ত দিচ্ছে, কারো মন চুড়িদার আর ব্যাগে , কেউ শেখাচ্ছে কিভাবে পেটানোটাও শিল্প হয়ে উঠতে পারে আর কেউ এত দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে  অফিসের 
যে সব তালার চাবি তার হাতে হয়ে জীবনটা গলায় চলে এসেছে। সব শূনে হতভম্ব হয়ে দুজনের গান পেল। ফাঁকা ফ্ল্যাট শুনল ওদের শেয়ালের কান্না । সেই কান্নাতেও যখন মাথায় হাত বোলাবার পাওয়া গেল  না কাউকে তখন তারা ঠিক করল দেহ রাখবে। সাতসকালে রাখা সেই দেহরা আবার জেগে উঠলো প্রায় সন্ধ্যাতে। যখন শোনা গেল একজন সারাদিনের ড্রাকুলাবৃত্তির পর মুক্তি পেয়ে রক্ত বন্ধ করে আসতে চলেছে। প্রায় হতাশ হয়ে দুজনে তখন চিকেন রোল চিবচ্ছিল কোথাও একটা বসে। চাপ না নিয়ে চিকেন রোলের দাবি মিটিয়ে ওরা ফিরে এল গন্তব্যে। এবারের গল্পটা আলাদাই। সবাই এসে গেল তাদের আসার আনন্দে খোলা হল রঙিন জল। দুরকমেরই। সেই রঙিন জলের জন্য চারপাশে যে বিপ্লব হচ্ছিল সেই বিপ্লবের সাক্ষি ছিল একটি ছেলে যে কোনায় বসে চুপচাপ অপেক্ষাকৃত নরম রঙিন জল ঢালছিল গলায় আর বুঝতে পারছিল উদ্দেশ্যহীনতা। যখন ভারী রঙিন জল বেসামাল করে ফেলছে এক এক জনকে , খুঁজে নিচ্ছে তাদের মধ্যের অসহায় মানুষটাকে ; বোঝা যাচ্ছে কেউ ভালো নেই। এই অসহায়তাটাই হয়তো সহজ করে তুলছে পরিবেশ। হঠাৎ ভেঙ্গে পড়া কান্নাতেই হোক অথবা অযাচিত খিল্লিতে- সবাই হালকা হতে চাইছে। ভেসে বেড়াতে চাইছে নিজেদের সমস্যাগুলোর থেকে দূরে। অনেকখানি দূরে। সুখ খুজছে না ওরা। শুধু মুহূর্তগুলো ওদের শান্তি দিচ্ছে অকারণ। এরই মাঝে বিরিয়ানি এবং রঙিন জল সহ্য করতে না পেরে বাথরুম খুঁজে চলেছে এক হতভাগা। বার ছয়েক নিজের অন্নপ্রাশনের ভাত উঠিয়ে এসে প্রায় ভিজে অবস্থায় সে মাটিতে শুয়ে। এদিক ওদিক হাত বাড়াচ্ছে। কি চাই সেটা নিজেও জানে না।জানা সম্ভবও নয় যদিও। মুখে হাসিটুকু লেগে আছে ঠিক। বোঝাচ্ছে ও ঠিক আছে। ওর ঠিক পাশে বসে খাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত সবাই খালি বুঝতে পারছে না কোনটা রুটি আর কোনটা চিকেন ভর্তা। একটা ছেঁড়া রুটিকে ছেড়ার প্রবল চেষ্টায় ব্যাস্ত একজন অন্যকে দেখিয়ে বলছে দেখ ও কিরকম ছড়াচ্ছে। ছড়াচ্ছে সবাই। শুধু আশা করা যাচ্ছে যে এই ছড়ানোগুলোকে জীবন গুছিয়ে রাখবে। স্মৃতির পাতায়।

                                                      ৩
গভীর রাতের হ্যাংওভার কখন কাটে জানা নেই। সাদা জল খেলে সেটা বোঝা যায় না। তবে চারপাশের মাথা ধরে অথবা ত্রিভঙ্গ অবস্থায় শুয়ে  থাকা মানুষগুলোকে দেখলে বোঝা যাচ্ছে যে খোঁয়ারি কাটেনি এখনো। শুধু বিরিয়ানির বিষ দেহ থেকে বার করা ছেলেটি সুস্থ হয়ে জানতে চাইছে কেউ কফি খাবে কিনা। কেউ সম্মতি দিচ্ছেনা বটে তবে বোঝা যাচ্ছে আপত্তিও নেই কারোরই। অবশেষে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কফি বানিয়েই আনল ছোকরা। cafe cofee day আশা করেনি কেউই তাই কাপে কফি নিয়েই ক্ষান্ত হল সবাই। কিন্তু তারপর যখন ছেলেটি প্রশ্ন করতে আরম্ভ করল ' কিরে? কেমন হয়েছে কফি? ' , পাগল করে দিতে লাগলো উত্তর না পেয়ে তখন সব্বাই একবাক্যে স্বীকার করল যে ক্যাফে কফি ডে তে ওর চাকরি বাঁধা।
এবং ততক্ষন বলতে লাগলো যতক্ষণ না ছেলেটি প্রশ্ন বন্ধ করছে।এবার প্রশ্ন এল বাড়ি ফেরার। রোববার হয়নি শেষ তখনও। তাই বাড়ি ফেরার বদলে ভাবা হল নতুন পাগলামোর কথা। আজও যদি থেকে যাওয়া হয় একইভাবে ? একই ভাবে নষ্ট করা যায় দিনটা ? প্রশ্নটা বড় হলেও উত্তরে আসতে দেরি হল না। কেউ বাঁধা পথে চলতে রাজি নয়। অতএব এখানেই রাত্রির আশ্রয়।
প্রশ্ন ছিল রঙিন জলেও। কিন্তু রঙ প্রশ্ন মেখে থাকে না বেশিক্ষণ। তাই প্রশ্ন ভেঙ্গে বেরিয়ে এল রঙিন জল। আগের দিনের মতো এলাহি আয়োজন নয়। চুমুকটুকুই থাকবে সাথে। চুমুকগুলোর গিয়ে থামল আলোচনায়। গান বাজনা আর দেদার ভুল বকার পর জীবনের পুরনো দরজাগুলোয় কড়া নাড়াবার পালা এবার। ঝুরঝুরে আর প্রায় ভেঙ্গে পড়া দরজাগুলোকে সামলাচ্ছিল পুরনো আমি অথবা আমরা। ঐ দরজা আর খুব পুরনো নিজেদের মাঝে মধ্যে সকলে খোঁজে,miss   করে। একলা সময়ে ,নির্জনতায়। আজ নির্জনতা নেই। তবু আজ খুঁজে পেতে অসুবিধা হচ্ছে না তাদের। নির্দ্বিধায় আসছে তারা। সিগারেটের ধোঁয়ারা ঘুরছে ঘরের মধ্যে। আগুন টেনে ধোঁয়া বের করে শান্তি পেতে চাইছে সবাই। শুধু বুঝতে পারছে না ভিতরে কোথাও আগুন লেগেছে খুব বড় করে, যার ধোঁয়া বেরোনোর পথ নেই। কারো গায়ে লেগে থাকা সিগারেটের আগুনের ছাপে, কারো চুরি যাওয়া টাকায়, আর কারো করে যাওয়া বিশ্বাসঘাতকতায় গোটা রাত বাড়ছে। প্রতিদিনই বাড়ে। অনেকগুলো ছাই পড়ে থাকে যেগুলোর নাম ভালবাসা। ভালবাসতে বাসতে আমরা বড় হই। পুরনো আমি কে কোথাও একটা হারিয়ে ফেলি আর খুঁজি ।আর খুঁজতে খুঁজতে বুঝে যাই জিনিসটা যেটাকে ভাবা হয়েছিল গোটা জীবন সেটা কখন যেন ধাক্কা মেরে ,দুমড়ে , পায়ের তলায় মাড়িয়ে চলে গেছে আমাকে। আমি পড়ে আছি, পড়ে থাকব ,বয়ে নিয়ে যাবো ক্ষতচিহ্নগুলো আর ভাঙব প্রতিরাতে। বোঝাবো নিজেকে ভালো আছি। চেষ্টাও করবো ঠিক। শুধু রাতটুকু আর অন্ধকার বেড়ে যাবে। সেসবের পরে এলোমেলো পাগলামিতে, মাতলামিতে ভালো  থাকতে চেষ্টা করবো বারবার। যতদিন না শেষটুকু দেখতে পাচ্ছি।

পুনশ্চ ঃ
রাতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মেই শেষ হয়। পাখি ডাকে সকালে। ঘুম ভেঙ্গে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়ি আবার। তবু কোথাও না কোথাও রাতগুলো থেকে যায়। একসাথে থেকে একে অপরকে বোঝাটুকু থেকে যায়। একে অপরকে হাসানোর চেষ্টাগুলো থেকে যায়। আমরা থেকে যাই। আর কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকে আমাদের ভিতরকার পুরনো মানুষগুলো। যারা হাসতে জানত প্রাণ খুলে। ভালবাসতে জানত চোখ বন্ধ করে। সেসব হারানো লোকগুলো ফিরে ফিরে আসবে বারবার। যতদিন আমরা একসাথে থাকব সবাই। ততদিনই পৃথিবীটা বড় সুন্দর হয়ে থাকবে... 

No comments:

Post a Comment